নির্দেশনা থাকলেও বেতন পাচ্ছেন না ‘পদত্যাগ করানো’ শিক্ষকরা
- আপলোড সময় : ২১-০১-২০২৫ ০৮:৫১:২০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২১-০১-২০২৫ ০৮:৫১:২০ পূর্বাহ্ন
সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের স্কুল-কলেজের প্রধানসহ অনেক শিক্ষককেই জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই শিক্ষকদের বেতন অব্যাহত রাখতে বললেও নির্দেশনা উপেক্ষা করে বেতন দেওয়া হচ্ছে না তাদের। ফলে তাদের অনেককেই পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। এমনকি যেসব শিক্ষকের বিষয় হাইকোর্ট থেকে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাদেরও অনেকে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানসহ অন্যান্য শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করার ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে জোর করে পদত্যাগ করানোর ঘটনা বন্ধ করতে নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পদত্যাগের শিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানপ্রধান এবং সহকারী শিক্ষকরা সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায়বিচার চান। এই পরিস্থিতি গত ১৯ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ জোর করে পদত্যাগ করানো শিক্ষকদের বেতন অব্যাহত রাখার নির্দেশনা জারি করে।
অফিস আদেশে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর এবং শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও হেনস্তা ও বেতন-ভাতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তে বলা হয়, জোরপূর্বক পদত্যাগ ও এর পেছনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিষয়ে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হয়। তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বেতন-ভাতা চালু থাকবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচলককে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন- গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে অনেক শিক্ষকই নিজ নিজ স্কুল-কলেজে যেতে পারছেন না। সারা দেশে এই সংখ্যাটি প্রায় ৩ হাজার; আর এসব শিক্ষক পদ হারিয়েছেন ২ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। তাদের বেতনভাতা বা এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) বন্ধ রয়েছে। তবে গণমাধ্যমের পক্ষে এ সংখ্যার সত্যতা খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি।
যদিও রাজধানীর ঢাকা সিটি কলেজ, ঢাকা মডেল কলেজ, মিরপুর কলেজ এবং বরিশালের গৌরনদীর মাহিলাড়া এ এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে এমন বেশ কয়েকজনের শিক্ষক পাওয়া গেছে; যারা এখনও চেষ্টা করেও বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা পাননি। সারা দেশে এমন শিক্ষকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
ঢাকা সিটি কলেজ :
গত বছর ৫ আগস্ট গত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৭ আগস্ট অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের পদ দখল করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নিয়ে এসে অধ্যক্ষ মো. বেদার উদ্দিনকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়া হয়। ঘটনার পর ওই দিনই সন্ধ্যায় নেয়ামুল হক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝে নেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আরও সাত জন শিক্ষককে বিদায় নিতে হয় প্রতিষ্ঠান থেকে। সবমিলিয়ে আট জন শিক্ষক বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।
জোর করে পদত্যাগ করানোর ঘটনায় অধ্যক্ষ মো. বেদার উদ্দিন হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। গত ২৭ অক্টোবর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর একটি আদেশ দেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের নিয়োগ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না - তা চার সপ্তাহের মধ্যে জানাতে রুল জারি করা হয়। আদেশে আবেদনকারীর আবেদন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিতদফতরের মহাপরিচালককে চার সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত সাপেক্ষে নি®পত্তি করতে বলা হয়।
জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মো. বেদার উদ্দিন বলেন, মন্ত্রণালয়ে থেকে বেতন চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হলেও আমিসহ আরও আট জন শিক্ষক বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। বেতন-ভাতার বিষয়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া কথা কিন্তু কোনো লক্ষণ নেই। হাইকোর্ট আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু সে ব্যাপারেও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বেদার উদ্দিন আরও বলেন, সারা দেশের ২ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। এসব শিক্ষক মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অথচ সরকারি নির্দেশনের পরও কোনও শিক্ষককের বেতন-ভাতা পাওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজ :
সরকার পতনের পর পরবর্তী পরিস্থিতিতে গত বছর ১১ আগস্ট ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবু আব্দুল্লাহ গত ১১ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নিয়ে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরার আবেদন করেও কলেজে ফিরতে পারেনি অধ্যক্ষ। জোর করে পদত্যাগ করানোর ঘটনায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে আবেদন, কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন-নিবেদন করেও কোনও ফল পাননি তিনি। ন্যায়বিচার পেতে রাজধানীর কাফরুল থানায় জিডি করেন।
অধ্যক্ষ সৈয়দ আবু আব্দুল্লাহ বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি করা হয়েছে জোর করে পদত্যাগ করানো শিক্ষকদের বেতন অব্যাহত রাখতে বলেছে। অথচ বেতন পাচ্ছি না। এমনকি আমাকে এখনও এখনও কলেজে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
মিরপুর কলেজ :
মিরপুর কলেজের উপাধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমানকেও জোর করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে দিতে পদত্যাগ পতে সই নেওয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে। পদত্যাগের ঘটনার জের ধরে এই শিক্ষককে নিগ্রহের শিকার হতে হয়।
উপাধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমি ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল। আমি ওই সময় প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্বে ছিলাম। গত বছর ৭ আগস্ট আমাকে পদত্যাগপত্র সই করিয়ে নেওয়া হয় ৮ আগস্টের ডেট দিয়ে। কারণ ৭ আগস্ট বেতন বিলে আমি সই করছিলাম। আমি এই ঘটনার পর পাঁচ মাসের বেতন পেয়েছি, এখনও দুই মাসের বেতন পাইনি।
মাহিলাড়া এ এন মাধ্যমিক বিদ্যালয় :
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া এ এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রণয়কান্তি অধিকারীকে পদত্যাগের আগেই সপরিবারে এলাকা ছাড়তে হয়। তারপরও তার পদত্যাগ ঠেকাতে পারেননি প্রধান শিক্ষক।
প্রধান শিক্ষক প্রণয়কান্তি অধিকারী সপরিবারে নিগ্রহের কারণে থানায় অভিযোগ করেছেন নিরাপত্তার চেয়ে। গত বছর ৩০ আগস্ট গৌরনদী মডেল থানায় অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, গত বছর ২৭ ও ২৮ জুলাই থানায় আমার স্ত্রী অভিযোগ করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ অভিযোগ গ্রহণ না করলে আমার স্ত্রী ফিরে আসেন। অগত্যা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আমাকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করে। একপর্যায়ে আমি বাধ্য হয়ে পদত্যাগপত্র হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেই।
প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। তা ছাড়া আমি তো প্রতিষ্ঠানেই যেতে পারছি না। -বাংলা ট্রিবিউন
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ